গুম খুনের জন্য তরুণ রাজনৈতিক কর্মীরাই ছিলেন র‌্যাবের প্রধান টার্গেট


প্রকাশের সময় : জুন ১২, ২০২৫, ১:০০ অপরাহ্ণ / ৬০
গুম খুনের জন্য তরুণ রাজনৈতিক কর্মীরাই ছিলেন র‌্যাবের প্রধান টার্গেট

শেখ হাসিনার জমানায় বাংলাদেশে বলপূর্বক গুম ও অপহরণের শিকার সবচেয়ে বেশি হয়েছিলেন তরুণ রাজনৈতিক কর্মীরা। ২৫৩ জন গুম হওয়া ব্যক্তির বয়স ও পেশাগত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, অধিকাংশই ১৯ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে, বিশেষ করে ২৭-২৮ বছর বয়সীরা ছিলেন গুমের শীর্ষে। এসব তরুণের বেশিরভাগই ছিলেন রাজনৈতিকভাবে সচেতন ও বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। ৪ জুন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে এই প্রতিবেদন জমা দেয় কমিশন। ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ: আ স্ট্রাকচারাল ডায়াগনোসিস অব এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, গুম হওয়াদের মধ্যে অন্তত ১০ জন ১৮ বছরের কম বয়সী ছিলেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, গুমের পেছনে কেবল চরমপন্থার ভয় নয়, বরং রাজনৈতিক দমনমূলক উদ্দেশ্য কাজ করছে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গত ২৭ আগস্ট গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন গঠন করে। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত গুমের ঘটনাগুলো তদন্ত করেছে এই কমিশন। গত ১৪ ডিসেম্বর ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ’ (সত্য উন্মোচন) শীর্ষক প্রথম অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেওয়া হয়। সেই প্রতিবেদনে গত ১৫ বছরে সংঘটিত বিভিন্ন গুমের ঘটনায় নির্দেশদাতা হিসেবে ক্ষমতাচ্যুত পলাতক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়ার কথা উঠে আসে। গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে বলা হয়, গুমের শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, বেসরকারি চাকরিজীবী, সাংবাদিক থেকে দিনমজুর পর্যন্ত ছিলেন। তবে শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ীদের গুমের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি, যা ইঙ্গিত দেয় যে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা রাখায় নির্দিষ্ট পেশাজীবী শ্রেণি বিশেষভাবে লক্ষ্যবস্তু হয়েছিলেন।

এতে বলা হয়, বয়স ও পেশার এই মিল আরও প্রমাণ দেয়, গুমের লক্ষ্য শুধু চরমপন্থা দমন নয়, বরং রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত কিংবা সংগঠিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এমন ব্যক্তিদের দমন।

গুমের সময়কাল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ভুক্তভোগীরা একদিন থেকে পাঁচ বছরের বেশি সময় নিখোঁজ ছিলেন। অর্ধেকের বেশি ৪৭ দিনের বেশি সময় নিখোঁজ ছিলেন। অনেকের গুমকাল কয়েক মাস থেকে কয়েক বছর, এমনকি ১৮০০ দিনের বেশি ছিল। কোনো সঙ্গতিপূর্ণ নিয়ম না থাকায় এটা স্পষ্ট যে, গুমের প্রক্রিয়া ছিল বিচারবহির্ভূত ও ভয়ভীতি সৃষ্টিকারী রাজনৈতিক নিপীড়নের হাতিয়ার।

প্রতিবেদনে বলা হয়, গুমের সময়কাল ‘কতদিন নিখোঁজ থাকব’—এই অনিশ্চয়তাই হয়ে উঠেছিল আওয়ামী শাসকগোষ্ঠীর ভয়ভীতি ও দমনমূলক কৌশল।

গোয়েন্দা সংস্থার ভূমিকা ও রাজনৈতিক দমন:

ভুক্তভোগীদের রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, গুমের শিকাররা প্রায়শই নিজের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা প্রকাশে সংকোচবোধ করেন। দীর্ঘ ১৫ বছর শেখ হাসিনার শাসনামলে বিরোধী রাজনৈতিক মতাদর্শ ধারণ করলেই শাস্তির ভয় তাড়া করতো। ভুক্তভোগীদের অনেকেই প্রথমে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করেন, পরবর্তীতে নিবিড় সাক্ষাৎকারে বিরোধী দলের সঙ্গে তাদের জড়িত থাকার কথা ধীরে ধীরে প্রকাশ পায়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২৫৩ মামলার মধ্যে ১০১ জনের রাজনৈতিক পরিচয় পাওয়া গেছে, যাদের বেশিরভাগই বিরোধী দলের সদস্য ছিলেন। তখনকার শাসকদলের (আওয়ামী লীগ) সঙ্গে সম্পৃক্ততার ঘটনা ছিল খুবই কম এবং সেগুলো মূলত দলীয় কোন্দল বা ব্যক্তিগত বিবাদের কারণে।

এতে আরও বলা হয়, গুমের ঘটনায় প্রধান ভূমিকা পালন করেছে র‌্যাব ও ডিজিএফআই। র‌্যাব পুলিশকেন্দ্রিক গোয়েন্দা সংস্থা হলেও, ডিজিএফআই সেনাবাহিনী নেতৃত্বাধীন। গুমের সময় ভুক্তভোগীদের জিজ্ঞাসাবাদে প্রায়শই রাজনৈতিক পরিচয়, মত ও সম্পৃক্ততা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হতো। পেশাগত দিক থেকে পুলিশ, র‌্যাব ও ডিজিএফআইয়ের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য থাকলেও তাদের জিজ্ঞাসাবাদের পদ্ধতি ও লক্ষ্য একই ছিল, অর্থাৎ ‘রাজনৈতিক দমন’।

৩৮ বছর বয়সী এক পুরুষ ভুক্তভোগীর কথা উল্লেখ করে গুম-সংক্রান্ত কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই ব্যক্তি ২০২২ সালে র‌্যাব কর্তৃক অপহরণ হন। পরে তাকে ১ বছর ৫ মাস গুম রাখা হয়। আরেকজন ২৬ বছর বয়সী ব্যক্তি ২০১৭ সালে র‌্যাব গোয়েন্দা ও র‌্যাব-১ কর্তৃক গুম হন ও ৪৮ দিন নিখোঁজ থাকেন। এই ঘটনাগুলো প্রমাণ করে, গুমের পেছনে শুধু নিরাপত্তা বা জঙ্গিবাদ দমন নয়, বরং বিরোধী রাজনৈতিক মতাদর্শ নির্মূলের উদ্দেশ্য ছিল।

প্রতিবেদন বিশ্লেষণে স্পষ্ট হয়েছে যে, গুমের শিকার তরুণরা রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় বা সংগঠিত হওয়ার সম্ভাবনা সম্পন্ন ছিলেন। গুমের সময়কাল ও পেশাগত বৈচিত্র্য বিচারবহির্ভূত দমনমূলক ব্যবস্থার পরিচয় দেয়। র‌্যাব ও ডিজিএফআইয়ের জিজ্ঞাসাবাদ থেকে বোঝা যায়, এই নিপীড়ন ছিল মূলত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

সুতরাং, বাংলাদেশের গুমের ঘটনাগুলো কেবল ‘জঙ্গি সন্দেহ’ বা ‘সন্ত্রাস দমন’ নয়, বরং তা ছিল গণতন্ত্রমনা বিরোধীদের দমন ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার একটি ভয়ঙ্কর হাতিয়ার।

আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১৩
১৫১৬১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
৩০