মিটার বাণিজ্যে সাবেক প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের ‘ভাই–বন্ধু’ চক্র


প্রকাশের সময় : নভেম্বর ১২, ২০২৪, ১:৪১ অপরাহ্ন / ২৯
মিটার বাণিজ্যে সাবেক প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের ‘ভাই–বন্ধু’ চক্র

বিদ্যুৎ খাতে সাড়ে চার কোটির বেশি গ্রাহককে প্রিপেইড মিটার দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছিল গত আওয়ামী লীগ সরকার। একে একে ছয়টি বিতরণ সংস্থা মিটার আমদানি করতে থাকে। এ নিয়ে কয়েক হাজার কোটি টাকা বাণিজ্যের সুযোগ তৈরি হয়। আর এ বাণিজ্যের পুরোটার নিয়ন্ত্রণ নেয় সাবেক বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের ‘ভাই-বন্ধু’ চক্র।

ছয়টির মধ্যে চারটি বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থার প্রিপেইড মিটার কেনার তথ্য সংগ্রহ করেছে প্রথম আলো। সংস্থাগুলোর দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ও মিটার আমদানির সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরা বলছেন, কিছু মিটার কেনা হয়েছে সরাসরি ক্রয়পদ্ধতি অনুসরণ করে। আর কিছু কেনা হয়েছে উন্মুক্ত দরপত্র ডেকে। তবে অভিযোগ আছে, সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী তাঁর বারিধারার বাসায় বসে ঠিকাদার চূড়ান্ত করে দিতেন। এরপর দরপত্র ডেকে কাজ দেওয়া হতো ওই ঠিকাদারের কোম্পানিকে।

প্রিপেইড মিটার স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০১০ সালে। মিটার সরবরাহ বাড়তে থাকে ২০২০ সালের পর। চীনের তিনটি কোম্পানি সেনজেন স্টার, হেক্সিং ও ওয়াসিয়ন গ্রুপ একটি চক্রে যুক্ত হয়ে সব মিটার সরবরাহ করে। মিটার–বাণিজ্যের নামে টাকা পাচারেরও অভিযোগ আছে এ চক্রের বিরুদ্ধে। যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধন পরিদপ্তর থেকে মিটার সরবরাহে যুক্ত একাধিক স্থানীয় কোম্পানির তথ্য সংগ্রহ করেছে প্রথম আলো। এসব কোম্পানিতে প্রতিমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া গেছে।

আগের কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই ২০১৯ সালে নেসকোতে মিটার সরবরাহের কাজ পায় ‘অকুলিন টেক’ নামের একটি কোম্পানি। চীনের সেনজেন স্টারের সঙ্গে যৌথভাবে ১০৭ কোটি টাকার এই কাজ পায় তারা। এরপর ২০২১ সালে তারা আবার নেসকোতে পায় প্রায় ৯২ কোটি টাকার কাজ। আর নেসকোতে কাজের অভিজ্ঞতা সনদ নিয়ে সবচেয়ে বড় বিতরণ সংস্থা পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডে (আরইবি) মিটার সরবরাহের কাজ নেয় অকুলিন। এখানে আরও বড় বাণিজ্য করে তারা।

নেসকোর একটি দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, তাদের কাজ দিতে তৎকালীন বিদ্যুৎসচিব আহমদ কায়কাউস চাপ প্রয়োগ করেন নেসকোর বোর্ডকে। কায়কাউস পরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন, দায়িত্ব পান মুখ্য সচিবের। বর্তমানে তিনি দেশের বাইরে আছেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রিপেইড মিটার কেনার ক্ষেত্রে চক্রের কথা জানি। বিভিন্ন অভিযোগে প্রিপেইড মিটারে এডিবি (এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক) একপর্যায়ে অর্থায়নও বন্ধ করে দিয়েছিল।’ তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নেওয়া প্রিপেইড মিটারের প্রকল্পগুলো যাচাই–বাছাই করা হচ্ছে। আর কোনো চক্র তৈরির সুযোগ দেওয়া হবে না।

যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধন পরিদপ্তরের তথ্য বলছে, অকুলিন টেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হলেন শাবাদ সাজিদ। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এই কোম্পানির প্রধান কারিগরি কর্মকর্তা হিসেবে হংকং থেকে যোগ দেন কে রুম্মান আখতার। তাঁরা দুজন শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিকের বন্ধু। অকুলিন মূলত মিটার ব্যবহারের প্রযুক্তিগত সহায়তা ও সফটওয়্যার সরবরাহের কাজটি নেয়। এর মাধ্যমে তারা দরপত্র নিয়ন্ত্রণ করে। এর বাইরে কেউ অংশ নিতে চাইলেও তাকে ভয় দেখিয়ে আটকানোর কাজটি করতেন নসরুল হামিদ।

নেসকোর তথ্য বলছে, সাতটি দরপত্রের মাধ্যমে মিটার সরবরাহের কাজ দেয় নেসকো। এর মধ্যে কোনো দরপত্রে দুটির বেশি কোম্পানি অংশ নেয়নি। ৪টি দরপত্রে ৫৫০ কোটি টাকার কাজ পেয়েছে চীনের সেনজেন স্টার আর তিনটিতে ৪৫০ কোটি টাকার কাজ পেয়েছে ওয়াসিয়ন। সেনজেন স্টারের সঙ্গে দুটিতে অংশীদার ছিল অকুলিন আর দুটিতে ছিল মিটার ডি টেক। সেনজেন স্টারের বাংলাদেশের স্থানীয় প্রতিনিধি (এজেন্ট) ছিলেন নসরুল হামিদের স্ত্রীর বড় ভাই প্রয়াত মোহাম্মদ সুজাত ইসলাম। করোনা মহামারির সময় তাঁর মৃত্যুর পর এ দায়িত্ব নেন তাঁর নিকটাত্মীয় মাহবুব রহমান ওরফে তরুণ। ওয়াসিয়নের সঙ্গে দুটিতে ছিল টেকনো ইলেকট্রিক্যাল ও একটিতে ছিল এসকিউ ট্রেডিং। এই তিন কোম্পানি এসকিউ গ্রুপের, যার মালিকানায় আছেন আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য আবু জাফর মো. শফিউদ্দিন ওরফে শামীম। ওয়াসিয়নের স্থানীয় প্রতিনিধি হলো এসকিউ।

একাধিক সূত্র বলছে, বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে আলোচিত খাম্বা সরবরাহের ব্যবসায় অন্যদের সঙ্গে যুক্ত ছিল এই শামীমের কোম্পানি। ২০২৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচনে তিনি প্রথমবারের মতো নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করে জয়ী হন। তিনি বর্তমানে আত্মগোপনে আছেন।

নেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাকিউল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মিটার কেনায় কাগজে-কলমে কোথাও কোনো অনিয়ম হয়নি। শুরুতে তিন দফায় ওরাকল সফটওয়্যারের লাইসেন্স ফি যুক্ত করে ৪১ ডলারে কেনা হলেও পরের চার দফায় ৩৫ ডলারে কেনা হয়েছে প্রতিটি মিটার।

তবে নেসকোর দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, দরপত্র জমার আগে নেসকোর প্রাক্কলিত দর প্রতিমন্ত্রীর বাছাই করা কোম্পানিকে বলে দেওয়া হতো। তাই তারাই সর্বনিম্ন দরদাতা হতো। যদিও প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রে এটি গোপন রাখার কথা। এ ছাড়া ঘুরেফিরে দুটি কোম্পানি প্রতিমন্ত্রীর সিদ্ধান্তে কমবেশি দর দিয়ে কাজ ভাগাভাগি করে পেতেন। নসরুল হামিদের নির্দেশের বাইরে কেউ দরপত্র জমা দিত না।

এর সত্যতা খুঁজে পাওয়া গেছে অন্তর্বতী সরকারের সময় ডাকা দরপত্রে। নতুন করে আট লাখ মিটার কিনতে প্রথম দফায় গত ২৪ অক্টোবর দরপত্র জমা নেওয়া হয়েছে। এবার সাতটি কোম্পানি অংশ নিয়েছে। এর আগপর্যন্ত ৭টি দরপত্রের মাধ্যমে সাড়ে ১৪ লাখ মিটার সরবরাহের কাজ দিয়েছে নেসকো।

পল্লী বিদ্যুতে মিটার কেনায় ‘হরিলুট’

মিটার–বাণিজ্যের জন্য আরইবিকে মূলত ‘টার্গেট’ করেছিল চক্রটি। ৩ কোটি ৬০ লাখের বেশি গ্রাহক আরইবির। এরা মূলত গ্রামের গ্রাহক, যাদের বিদ্যুতের ব্যবহার কম। ৮০টি সমিতির মাধ্যমে এ কাজটি করে তারা। এ পর্যন্ত ১৭ লাখ মিটার বসানো হয়েছে; আর ৫ লাখ ৬০ হাজারের কাজ চলছে। প্রকল্প করে মিটার কেনার কাজটি করে আরইবি, তারপর তা ভাগাভাগি করে বিভিন্ন সমিতিতে পাঠানো হয়। আবার সমিতির নামে দরপত্র দেয় আরইবি। ওই সমিতিকে তার অংশের বিল পরিশোধ করতে হয়। আরইবির বাড়তি দামে কেনাকাটা নিয়ে সমিতির কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ আছে। ২০২০ সালে পাঁচটি সমিতির নামে আরইবির অস্বাভাবিক দামে কেনাকাটার কিছু তথ্য প্রথম আলোর হাতে এসেছে।

আরইবির নথি যাচাই করে দেখা গেছে, আরইবি ৫ লাখ স্মার্ট প্রিপেইড মিটার কিনতে ২০২২ সালে দরপত্র আহ্বান করে। এখানেও দুটি দরপ্রস্তাব জমা পড়ে, দুটিই শামীমের সঙ্গে সম্পর্কিত। এর মধ্যে যৌথভাবে কাজ পায় অকুলিন টেক ও শামীমের এসকিউ ওয়্যার অ্যান্ড কেব্‌লস। দরপত্রে অংশ নেওয়া অন্য কোম্পানি ভিকার ইন্টারন্যাশনাল হলো আওয়ামী লীগের ২০০৯-২০১৪ মেয়াদে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা এনামুল হকের ভাই নাজমুল হকের।

মিটার ও কমিউনিকেশন সিস্টেম সরবরাহের নামে ১ হাজার ২৩৫ কোটি টাকা দর দিয়ে যৌথভাবে কাজটি পায় অকুলিন ও এসকিউ। এতে প্রতিযোগিতামূলক দামের চেয়ে অন্তত ৬১৭ কোটি টাকা বাড়তি নিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। তাঁরা বলছেন, এ প্রকল্পের মিটার সরবরাহ এখনো শুরু হয়নি, চাইলে সরকার এটি বাতিল করতে পারে।

পুরোনো বঞ্চিত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাড়ে চার হাজার টাকার মিটারের দাম ধরা হয়েছে ৬ হাজার ২২০ টাকা। মিটারের জন্য এনআইসি কার্ডের দাম ধরা হয়েছে ৫ হাজার ২৯৫ টাকা, যেটির দাম কোনোভাবেই ২ হাজার টাকার বেশি হবে না। একটি ডেটা কনসেনট্রেটর ইউনিট (ডিসিইউ) বসাতে এক লাখ টাকা খরচ হওয়ার কথা, আরইবি কাজ দিয়েছে ৩ লাখ ১৩ হাজার টাকায়। এমন ১ হাজার ৬০০টি ডিসিইউ বসানো হয়েছে। এভাবে সবকিছুতে বাড়তি দাম ধরা হয়েছে।

এসকিউ গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক নাফিজা ইসলাম গত ৩০ অক্টোবর প্রথম আলোকে বলেন, ‘শামীম সাহেবের ভাইদের একসঙ্গে ব্যবসা আছে, আবার সবার আলাদা ব্যবসাও আছে। তবে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের মাধ্যমেই তাঁরা কাজ পেয়েছেন।’

নামাজের সময় সূচী

  • ফজর
  • যোহর
  • আছর
  • মাগরিব
  • এশা
  • সূর্যোদয়
  • ৫:১০ পূর্বাহ্ণ
  • ১১:৫৩ পূর্বাহ্ণ
  • ৩:৩৫ অপরাহ্ণ
  • ৫:১৪ অপরাহ্ণ
  • ৬:৩৩ অপরাহ্ণ
  • ৬:২৭ পূর্বাহ্ণ