দুর্নীতির আখড়া বিএলআরআই, নেপথ্যে ডিজি তার স্ত্রী


প্রকাশের সময় : জানুয়ারী ১২, ২০২৩, ১০:৩৭ অপরাহ্ন / ৯৯৭
দুর্নীতির আখড়া বিএলআরআই, নেপথ্যে ডিজি তার স্ত্রী

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট : বাংলাদেশ প্রাণী সম্পদ গবেষণা ইন্সটিটিউটকে (বিএলআরআই) লুটপাট ও দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিনত করেছেন সংস্থাটির মহাপরিচালক ড. জাহাঙ্গীর হোসেন। নিয়োগ ও পদোন্নতিতে ঘুষ, কেনাকাটায় দুর্নীতি, নারী কেলেঙ্করি, বিভিন্ন প্রকল্পের আত্মসাৎসহ তার বিরুদ্ধে পাওয়া গেছে এন্তার অভিযোগ। বিএলআরআইয়ের নিজস্ব তদন্ত প্রতিবেদন ও মন্ত্রণালয়ের ভুক্তভোগীদের জমা দেওয়া অভিযোগ থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। এসব অভিযোগের বিষয়ে ড. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘কিছু অভিযোগ পুরনো যা ইতোমধ্যে নথিভুক্ত হয়ে গেছে। আর কিছু অভিযোগ আছে অপপ্রচার।’

সাভারে অবস্থিত বিএলআরইতে সম্প্রতি ২২ জন কর্মকর্তা নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এরমধ্যে ১৮ জন এনিমেল হাজবেন্ট্রি কর্মকর্তা, ২ জন ভেটেরেনারি চিকিৎসক ও ২ জন কৃষি অর্থনীতিবিদ নিয়োগ দেয়ার কাজ চলছে। এসব পদে লিখিত পরীক্ষায় উর্ত্তীর্ণ প্রার্থীদের কাছে সরকারি ঘুষ দাবীর কিছু অডিও রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ছড়িড়ে পড়েছে। মন্ত্রণালয়েও একাধিক প্রার্থী মৌখিক ও লিখিত অভিযোগ দেন। এতে বলা হয় চাকুরি প্রত্যাশী ২২ জনের কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা করে কমপক্ষে ৪ কোটি টাকা ঘুষ আদায় করা হয়েছে।

অভিযোগে বলা হয়, মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান বিএলআরআইতে ২২ জন কর্মকর্তা নিয়োগের জন্য গত ২৭ জুলাই ১২ আগষ্ট পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। গত ২৬ নভেম্বর থেকে ২৮ মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। লিখিত পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর প্রাণী সম্পদ গবেষণা ইন্সিটিউটের একাধিক কর্মকর্তা ফোন করে প্রার্থীদেরকে বলেন চাকরি পেতে হলে ২০ লাখ টাকা করে দিতে হবে। এর মধ্যে ছাগল উন্নয়ণ গবেষণা বিভাগের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা লিপি রাণী সরকার তার ব্যবহৃত ০১৭৭০০৭৩৯১৩ মোবাইল ফোন ও হোয়াটসআপ থেকে একজন চাকরি প্রার্থীকে কল দেন। তিনি বলেন ‘ডিজি ড. জাহাঙ্গীর হোসেনের স্ত্রী নাসরিন সুলতানা এবং অতিরিক্ত পরিচালক জিল্লুর রহমান পুরো বিষয়টা দেখ বাল করছেন। টাকা দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হলে মহাপরিচালকের স্ত্রী নাসরিন সুলতানা নিজেই এ বিষয়ে কথা বলবেন।’ প্রসঙ্গত ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক জাহাঙ্গীর হোসেনের স্ত্রী নাসরিন সুলতানা নিজেও বিএলআরআইয়ের পরিচালক (গবেষণা) পদে কর্মরত।

কল রেকর্ডে লিপি রানী সরকার আরও বলেন, ‘ডিজি জাহাঙ্গীরের স্ত্রী নাসরিনের বান্ধবী মন্ত্রণালয়ের বড় কর্মকর্তা। যারা এরমধ্যে চাকরির জন্য টাকা দিয়েছে তারা ডিজির স্ত্রীর কাছে দিয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি ওই চাকরি প্রার্থীকে ৬/৭ বার কল দিয়েছি। আপনারা প্রস্তাবে রাজি হলে মৌখিক পরীক্ষার আগে আপনাদেরকে কিছু প্রশ্নপত্র সরবাহ করা হবে এবং আপনাদের চাকরি নিশ্চিত করা হবে।’ এধরনের একাধিক কল রেকর্ড আমাদের হাতে রয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চাকরি প্রত্যাশী একাধিক ভুক্তভোগী জানান, লিপি রাণী সরকারসহ কয়েকজন কর্মকর্তার মাধ্যমে মহাপরিচালকের স্ত্রী নাসরিস সুলতানা চাকুরি প্রার্থী ২২ জনেরে কাছ থেকে ৪ কোটি টাকারও বেশি আদায় করে তাদের চাকরী নিশ্চিত করছেন। ভুক্তভোগীরা বিষয়টি মন্ত্রাণালয়ের সচিবকেও ফোন করে অভিযোগ করেন। এবিষয়ে জানতে চাইলে লিপি রানী সরকার বলেন, আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ পালন করেছি মাত্র।

এদিকেবিএলআরআইয়ের মহাপরিচালক ড. জাহাঙ্গীর হোসেনের বিরুদ্ধে কিছু সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তদন্ত করেন বিএলআরআইয়ের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বিভাগীয় প্রধান ড. মো. গিয়াস উদ্দিন। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, বিএলআরআইয়ের প্রবিধান অনুসারে সরকারি চাকরিতে ৫ বছরের অভিজ্ঞতা না থাকার পরও ২০০৫ সালে তৎকালীন জোট সরকারের চাপে তাকে চাকরিতে বাধ্য হয় প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়। পরে তিনি নব্য আওয়ামী লীগ সাজেন। তিনি প্রকল্প পরিচালক থাকার সময় বিজ্ঞানীদের মতামত উপক্ষে কারে আরসিসি জাতের গাভী ক্রয়ে ২৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন। এই বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন তিনি টেন্ডার না করে কোটেশনের মাধ্যমে গাভী ক্রয় করেন। যা অনুমোদিত স্পেসিফিকেশন অনুসারে ছিল না। গাভী দৈনিক চার লিটার দুধ দিতে সক্ষম বলা হলেও বিএলআরইয়ের নাইক্ষংছড়ি আঞ্চলিক কেন্দ্র পরিদর্শন করে যে চারটি গাভী দুধ দিচ্ছে সেগুলো পাওয়া গেছে বয়স্ক। যেগুলোর দুধ দেওয়ার সক্ষমতা ছিল দেড় থেকে দুই লিটারের মধ্যে।

ড. জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে যৌন নিপিড়নের অভিযোগ করে দুই নারী বিজ্ঞানী এবং কয়েকজন মহিলা কর্মকর্তা কর্মচারি। এবিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তা প্রতিবেদনে বলেন, অভিযোগগুলো স্পর্শকাতর হওয়ায় সতর্কতার সঙ্গে তদন্ত করা হয়। কেউ তার বিরুদ্ধে অভিযোগুলো অস্বীকার করেননি।

বিএলআরআইয়ের ডিজি জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি দুর্নীতি অনিয়মের মাধ্যমে সাভারে ১০ বিঘা জমির মালিক হয়েছেন। যার মূল্য আনুমানিক ৪৫ কোটি টাকা। তিনি পাবনা ও মুন্সীগঞ্জে গরু খামার, আরসিসি প্রকল্প পরিচালক, দেশী মহিষ ও ক্রস মহিষ প্রকল্প ও ছাগল উন্নয়ন প্রকল্পসহ বিভিন্ন প্রকল্পের দায়িত্ব পালনকালে অনিয়ম দুর্নীতির মাধ্যমে এই সম্পদ অর্জন করেন। তদন্তকালে ড. জাহাঙ্গীরের সাভারে দুটি এলাকায় ২৪ দশমিক ২৫ ও ১৩ দশমিক ২৫ শতাংশ অর্থাৎ ৩৮ শতাংশ জমি পাওয়া যায়। যার মূল্য দেখিয়েছেন মাত্র ২১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। প্রতিবেদনে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, ড.জাহাঙ্গীর যেসব সম্পদের তথ্য গোপণ করেছেন তা জানা কঠিন। এবিষয়ে অধিকতরও তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। তাছাড়া সাভারে ৩৮ শতাংশ জমির দাম সাড়ে ২১ লাখ টাকা দেখানোর বিষয়টিও বিশ্বাসযোগ্য নয়।

এছাড়া ড. জাহাঙ্গীর কোরবানীর ঈদে মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবসহ বিভিন্ন জনকে ১০ টি করে ষাঁড় উপহার দেন। যেগুলো কোন ধরনের স্লিপছাড়া বিএলআরআই থেকে বের করে নেওয়া হয়।

 

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ড. জাহাঙ্গীর নামে বেনামে চেক দিয়ে চার বছরে ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার নামে সাড়ে ১৭ লাখ টাকা, আউট সোসিং কম্পাউন্ডারের নামে সাড়ে ৭ লাক টাকা ও দৈনিক হাজিরা কর্মী প্রতি রানী সাহার নামে ১৩ লাখ ৬১ হাজার টাকা উন্মুক্ত চেকের মাধ্যমে তুলে নেন। এসব অর্থ বিধিবহির্ভূতভাবে তুলে নেন বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। এছাড়া ডিজি জাগাঙ্গীর একেকটি আরসিসি গরু ক্রয় করেছেন ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা করে। যার বাজারমূল্য মাত্র ৫০ হাজার টাকা। বিভিন্ন এলাকায় ভুয়া ট্রেনিং দেখিয়ে এক কোটি ৭৭ লাখ আত্মসাৎ করেন। গরুর শেড, টেনিং ভবন, নাইক্ষং ছড়ি শেড, রাজশাহী শেডসহ বিভিন্ন নির্মাণকাকে ভুয়া টেন্ডার দেখিয়ে নিজের ভাইকে দিয়ে কাজ করেন অর্থ আত্মসাৎ করেন। তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, ১০টি আরসিসি গরু ক্রয়ে দুই বছরে ৯ লাখ ৭১ হাজার ৮৫০ টাকা বিল দেন। সরেজিমন পরির্দশনে দেখা যায় অনেক বেশি দামে গরুগুলো ক্রয় করা হয়েছে। গাভীগুলো খুবই দুর্বল ছিল এবং দুধ উৎপাদনের স্পেসিফিকেশন অনুসযায়ী পাওয়া যায়নি।

তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে ড. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে এসব অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। এসব প্রতিবেদনের পর প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে আলাদা দুটি তদন্ত করা হয়। সেগুলোর সত্যতা না পাওয়ায় নথিভুক্ত করা হয়েছে। তার কাছে নথিভুক্তির চিঠি দেখতে চাইলে তিনি বলেন, এগুলো লিখিতভাবে জানানো হয় না। মৌখিকভাবে জানিয়ে দেয় যে বিষয়টি নথিভুক্ত হয়ে গেছে।

বাংলাদেশ প্রাণী সম্পদ গবেষণা ইন্সটিউটের মহাপরিচালক ড. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, বিষয়টি বেশ কিছু দিন আগের। আমি বা আমার স্ত্রী ঘুষের সঙ্গে জড়িত নয়। কেউ আমাদের নাম ব্যবহার করে থাকতে পারে। যারা কাজটি করেছে আমরা তাদেরকে চিহ্নিত করেছে। তাদের বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী পদক্ষেপ নিচ্ছি।

নামাজের সময় সূচী

  • ফজর
  • যোহর
  • আছর
  • মাগরিব
  • এশা
  • সূর্যোদয়
  • ৪:৩০ পূর্বাহ্ণ
  • ১১:৫৯ পূর্বাহ্ণ
  • ৪:২৩ অপরাহ্ণ
  • ৬:১১ অপরাহ্ণ
  • ৭:২৫ অপরাহ্ণ
  • ৫:৪২ পূর্বাহ্ণ