ঈদ মানে আনন্দ। ঈদ মানে খুশি। তার ওপর এটি যদি হয়, ঈদ উল ফিতর তবে তো আর কথাই নেই। আনন্দ আর খুশির মাত্রা বেড়ে যায় বহুগুণ। কারণ দীর্ঘ এক মাসের সংযম, ত্যাগ আর সিয়াম সাধনার পর মুসলমানেরা এই দিনটি খুব আনন্দের সাথে পালন করে থাকে। বাংলাদেশ একটি মুসলিম প্রধান দেশ এবং ঈদ উল ফিতর হলো একটি অন্যতম বৃহত্তম বাৎসরিক উৎসব। তবুও জাতি-বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে দেশের প্রতিটি মানুষ ঈদের এই আনন্দে সামিল হয়। সবার মুখে আনন্দের হাসি। সকল দুঃখ-কষ্ট ভুলে অন্তত ঈদের দিনে যে যার সাধ্য মতো খুশিতে মেতে উঠে। তবে সবচেয়ে বেশী খুশি ছড়িয়ে পড়ে প্রতিটি শিশুর মুখে। এ যেন বাঁধ ভাঙা হাসির মেলা। তারা ঈদের নতুন জামা-কাপড় পড়ে সকাল থেকে শুরু করে সারাটা দিন যেমন ফুলের মতো ঘুরে বেড়ায়, দেখেই মনটা আনন্দে ভরে যায়। আর ভাল লাগে, ঈদের নামাজ শেষে সবাই যখন খুশি মনে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে কোলাকুলি করে।
তাই বলে বড়দের আনন্দ যে কম, সেটা ভাবা ঠিক নয়। সারাদিন টো টো করে ঘুরা ও আত্মীয়-স্বজন আর বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে তারা দিনটিকে ইনজয় করে থাকে। সারাদিন ঘুরে ক্লান্ত হয়ে যখন ঘরে ফিরে, তখনও বাকি আছে যাদুর বাক্স মানে টেলিভিশন আনন্দ দেবার। ঈদ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন চ্যানেল বেশ কয়েকদিন ধরে প্রচার করে থাকে ঈদের বিশেষ অনুষ্ঠানমালা।
উজ্জল মোল্লা (সাংবাদিক) ভাইয়ের অনুরোধে শৈশবের ঈদ স্মৃতি লিখতে বসেছি। যদিও উনি কোন ঘটনা বা ঈদ স্মৃতি নিয়ে ছোট গল্প লিখতে বলেছেন। কিন্তু আমার তেমন কোন গল্প নাই। তাই শৈশবের ঈদ স্মৃতিই লিখলাম।
আমার ঈদ স্মৃতি খুবই সাধারণ। পানসে। বর্ণহীন। শুধুশুধু একে আর রঙিন করে কোন লাভ নেই। বরং এবারের ঈদই আমার কাছে ব্যতিক্রম। স্মরণীয়। কষ্টদায়ক। মা’কে ছাড়া সব কিছুই কেমন জানি ফাঁকা ! আনন্দহীন। শূন্যতায় ভরপুর। কোন কিছুতেই মন ভরে না।
ছোটবেলার ঈদ স্মৃতি বলতে, যে কথাটি সবার প্রথমে মনে আসে সেটি হলো, সকল মুসলমান বাড়ির মতো নিজের ঘরে খাবার-দাবারের আয়োজন। সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখতাম, মা পায়েস আর সেমাই রান্না করে রেখেছে। আর দুপুরের জন্য চলছে মাছ-মাংস-পোলাও-এর আয়োজন। নাস্তা নাই ! আমি আবার সকালে মিষ্টি খেতে চাইতাম না। মেজাজ বিগড়ে যেত। তারপরও ঈদ বলে কষ্ট করে চালিয়ে দিতাম।
এরপর ঈদের নামাজ শেষে, বাবার অফিসের কিছু সহকর্মী বাসায় আসত। তাদেরকে পায়েস ও সেমাই পরিবেশন করা হতো। ভাল লাগত। ঈদের আমেজ ছড়িয়ে যেত আমাদের ঘরে।
এরপর দুপুরের খাওয়া শেষ করে শুরু হতো বিভিন্ন চ্যানেলের প্রোগাম দেখা। মানে, যখন থেকে বাংলাদেশে ডিশ এসেছিল। এখানে কিঞ্চিৎ মজার ছিল। তখন টেলিভিশন ছিল একটি আর দর্শক ছিল কয়েকজন। তাই কোন প্রোগাম দেখা হবে তা নিয়ে শুরু হয়ে যেত টানা পোড়ন। পরিবারের একমাত্র ছেলে এবং সবার ছোট বলে আমার প্রাধান্যই ছিল বেশী। তবে বেশী সমস্যা হতো, রাতের বেলা নাটকের সময়। অনেক চ্যানেলের ভিড়ে একটি নাটক খুঁজে বের করা আসলেই কষ্টকর। এ সময় হুমায়ূন আহমেদের নাটক থাকলে বাবা-মা’র জন্য সেটাই দেখা হতো। এরপর বেশী রাতের প্রোগামগুলো আমরা দুই ভাই-বোন মিলে দেখে, রাত পার করে দিতাম। এখন অনেক কিছুই বদলে গেছে।
ঈদে কেনাকাঁটা কিংবা ঘোরাঘুরি কখনো করা হয়নি। পরিবারের সকল সদস্যের সাথে সময় কাঁটাতেই আমার ভাল লাগে। এখনো। বাবার বন্ধুদের কাছ থেকে বিভিন্ন উপহার পেতাম। পরে বাবা চাকুরি থেকে অবসর নেবার পর আর পাওয়া হয়নি। এখন অবশ্য বড় বোনের কাছ থেকেই পেয়ে থাকি।
ঈদে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকতো। বেশ কয়েকটা দিন বাহিরে না যাবার চিন্তায় ভালই কাঁটতো। সারাদিন গান শুনা, টিভি ও মুভি দেখা এবং রাত জেগে পরদিন দেরী করে ঘুম থেকে উঠার মজাই ছিল আলাদা।
সময়গুলো দ্রুত পাল্টে যায়। কেমন করে জানি বড় হয়ে গেলাম ! আর এখন, গেলাম ! আর এখন, না চাইতেও যেন চিন্তার পাহাড় মাথায় চলে আসে। এর চেয়ে ঢের ভাল ছিল, আমার ছোটবেলা। কোন চিন্তা ছিল না। জীবন যুদ্ধের মানে জানা ছিল না। আরো অনেক কিছুই তখন ছুঁয়ে যেত না। খুব মিস করি, সেদিনের দিনগুলো। মা ও বোনের সাথে সেসব খুনসূটি। সবাই এক ঘরে বসে অনেকক্ষণ সময় কাঁটানো। রাত-জাগা। মান-অভিমান। সব, সব।
ঈদ, পূঁজো, বড়দিন, পহেলা বৈশাখের মতো উৎসবময় দিনগুলো কিংবা যে কোন পারিবারিক অনুষ্ঠানে এখন আর আগের মতো আনন্দ পাই না। চারিপাশে অনুভূত হয়, মা না থাকার এক নীরব স্তবতা। সবকিছু যান্ত্রিক মনে হয়। আবেগহীন ও অনুভূতি শূন্য। বুকের মধ্য দিয়ে বয়ে যায় চাপা গরম নিঃশ্বাস। ফাঁপরে দম আঁটকে যায়। এলোমেলো মনে হয় নিজেকে। তারপরেও উঠে দাঁড়াতে হয়। সময়ের দাবি মেনে নিতে হয়। বেঁচে আছি সেই প্রচেষ্টায়।
ঈদ আনন্দের। না পাবার মাঝেও অনেক কিছু পাওয়া। তাই ঈদ প্রতিটি মানুষের জীবনে বয়ে আনুক অনাবিল আনন্দ, হাসি এবং সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সংযম, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির পরিবেশ পরিব্যাপ্তি লাভ করুক – এটাই হোক ঈদ উৎসবের ঐকান্তিক কামনা।
সবাইকে ঈদের প্রাণঢালা শুভেচ্ছা ও আন্তরিক অভিনন্দন।
আপনার মতামত লিখুন :